ফ্ল্যাপ অনেকটা সময় একরকম করে বসে থেকে শরীর লেগে আছে। একটু ঘুরে বসতে চাইল মিরু। ডানে-বায়ে নড়ে বসতেই চেয়ারটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে কেঁদে উঠল। ভেঙে যাবে না তো? অবচেতনে নিজের তলপেট আঁকড়ে ধরল ও। সদ্য জানান দেওয়া যে অস্তিত্বটা ওর শরীরজুড়ে, তার কোনোবা ক্ষতি হতে দেবে না যেন! ডান হাতের পরে বাঁহাতটাও তলপেটে রাখল ও। আদর করার ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরল। যে ভ্রুণটা আরেকটা মিরু হয়ে পৃথিবীতে আসতে চাইছে, নিজের সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে তাকে অনুভব করতে চাইল। চোখ মুদে আত্মায় অনুভব করতে চাইল নিজের সন্তানকে। তারপর বিদ্রুপাত্মক হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটজুড়ে, বড়ো নির্মম আর ক্রুর সে হাসি! এই অনাগত সন্তানকেই তো হত্যা করতে এখানে এসেছে মিরু! মিরু যেন ছোটো হৃদপিণ্ডের কম্পনগুলোর সারগাম শুনতে পেল। টের পেল ওই কোমল কলির মতো শরীরটুকুনের উষ্ণতা! মিরুর একটু ছুঁতে ইচ্ছে করল ছোট্ট মানুষটাকে। একটু কোলে নিতে ইচ্ছে করল। বুকের একদম ভেতরে নিয়ে বাচ্চাটাকে চেপে ধরতে মন কেমন করল। ছোটো আঙুলগুলোকে পেঁচিয়ে ধরার জন্য ওর আঙুলের ডগায় ডগায় ব্যথার বোধ ঢেউ তুলল, শরীরজুড়ে পিপাসা পেল। পেয়েও সব হারানোর যন্ত্রনায় ওর কষ্ট শুরু হলো। গলার নিচের দিকে, শ্বাসযন্ত্রটাকে ঠেসে ধরে, এক দলা কান্না ঘুরে ঘুরে পাকিয়ে উঠল। দমবন্ধ লাগতে লাগল ওর। ও চোখ বন্ধ করে ফেলল। বুজে থাকা চোখের পানিতে ভিজে যেতে লাগল ওর দুই গাল, চিবুক, বুক, হৃদয়ের অলিগলি! - 'আম্মা, কাঁদতেছেন কেন? কষ্ট হইতেছে? তাইলে ফালায়েন না বাচ্চাডা। রাইখা দেন। ছোটো স্যাররে সব খুইলা কন। আমনে না কন আমি কই? নাইলে মিয়াভাইয়ের কাছে চইলা যান। মিয়াভাই আপনারে চোখে হারায়। বাচ্চার কথা জানলে আপনারে তারা মাথায় কইরা রাখব। সব ঠিক হয়ে যাবে, আম্মা! বাচ্চা জানটারে বাঁচায়ে রাখেন! বাচ্চা জানটার তো কোনো দোষ নাই!’ এক মুহূর্তের জন্য মিরুর পুরো পৃথিবীটা ভীষণ রকম সুখী হয়ে উঠল। কী সুন্দর কথা! বাচ্চা জান! বাচ্চা একটা জান! খুব কি ক্ষতি হবে এই বাচ্চা জানটা পৃথিবীতে এসে গেলে? একটা গোলুমোলু মেয়েবাবু আসুক। তার নাম দেবে ও টুইটুবানির ফুল! আদর করে টুইপাখি বলে ডাকবে ওকে। পুরো নাম ধরে ডাকবে না মিরু ওকে। ছোটো করে ডাকবে ‘টুইপাখি? ও টুইপাখি? আমার টুইটি বার্ড কই রে?’ তারপর ছড়া বাঁধবে মিরু, “কই আমার টুই? তুই আমার টুই! আমার পাখি কই? এই যে আমার টুই! আমার ফুল কই? এই যে আমার টুই! তুই ফুল, পাখি তুই। তুই আমার টুই। কই আমার টুই?” মিরুর অমন ইকরিমিকড়ি ছড়া শুনে টলটলে পায়ে থপথপ করে বুকে ঝাঁপ দেবে টুই নামের পাখিটা। তারপর বিড়ালছানা হয়ে টুপ করে ঢুকে যাবে মিরুর বুকের ভিতর। ঠিক যেমন করে বুকের ভেতর চুপটি করে ঢুকে যেত হারিয়ে যাওয়া ছোটো ভাইটা! ভাইয়ের মতো করে টুইটুবানির ফুলটাও হারিয়ে যাবে! দুই হাত বাড়িয়েও ওকে ছুঁতে পারবে না মিরু। কখনো পারবে না! সোজা হয়ে বসল মিরু। রাহেলার কথা ওকে আবেগপ্রবণ করে দিয়েছিল। এখন বাস্তবে ফিরল ও। মিরু জানে, যা হচ্ছে, তাকে আর ফেরানো সম্ভব না। এই বাচ্চাটা মিরুর কোলে আসবে না। হাসবে না ও মিরুর হাসিতে। মিরু কিছুতেই এই বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আনবে না। ওর অদ্ভুত ভাগ্যের সাথে কিছুতেই মেলাবে না আর একটা নতুন, নিষ্পাপ জীবনকে। মিরু হলো দুঃখ পাথর। বিশাল দুনিয়ার কোথাও ওর জন্য এক ফোঁটা সুখ লিখে রাখেননি ওর ঈশ্বর। না হলে কেন সব এমন হবে? সব সুখ মুঠোয় এসেও কেন অধরা হয়ে থাকবে? ছুঁয়ে দিয়ে, আদর করে মুঠোয় আঁকড়ে, বুকে চেপে ধরে রাখলেও কেন সব সুখেরা বুদবুদ হয়ে উড়ে যাবে? রাহেলার হাত ধরে ক্লিনিকে এসেছে মিরু। এবরশন করাতে এসেছে। প্রতারক জীবনসঙ্গী অমিতের সাথে অনেক হিসাব-নিকাশ আছে ওর। কিন্তু সেই নিক্তির বাটখারা এই বাচ্চাটা হবে না। বাচ্চাটাকে আনবে না ও এই পৃথিবীতে। বড়ো কঠিন এই দুনিয়া! শুধু দুঃখ দেয়!
বই সম্পর্কে আরও জানতে স্ক্যান করুন
QR কোড স্ক্যান করুন
customer 2
17 Aug 2025, 02:12AM
Great Book from customer5!
Masihur Rohman
11 Aug 2025, 04:55PM
Great Book from customer5!
Ayman Rahman Chowdhury
11 Aug 2025, 04:49PM
Great Book from customer5!